রিয়ালের হয়ে যে ইতিহাস গড়ে বিদায় নিচ্ছেন আনচেলত্তি

বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে কিছু নাম চিরকাল অমর হয়ে থাকবে। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন কার্লো আনচেলত্তি। একজন স্বপ্নবাজ কোচ, যিনি শুধু ক্লাবকে ট্রফি এনে দিয়েছেন না, খেলোয়াড়দের হৃদয়েও জায়গা করে নিয়েছেন। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে তার দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষপ্রান্তে এসে তিনি যে ইতিহাস গড়ে বিদায় নিচ্ছেন, তা কেবল পরিসংখ্যান নয়—এ এক আবেগ, বিশ্বাস আর ঐতিহ্যের গল্প।

রিয়ালের ইতিহাসে অন্যতম সফল কোচ

রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে অনেক নামী কোচ এসেছেন-গেছেন। কিন্তু আনচেলত্তি ছিলেন আলাদা। প্রথম মেয়াদে (২০১3-2015) তিনি রিয়ালকে দশম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ‘লা ডেসিমা’ এনে দিয়েছিলেন, যেটার জন্য ক্লাব ১২ বছর ধরে অপেক্ষায় ছিল। সেই স্মরণীয় ফাইনালে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ে দুর্দান্ত জয়ে রিয়াল আবার ইউরোপের রাজত্ব ফিরে পায়। এই জয়ের পর থেকেই মাদ্রিদ সমর্থকদের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছেন আনচেলত্তি।

তার দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হয় ২০২১ সালে। অনেকেই ভেবেছিলেন হয়তো এটা একটি “ফেয়ারওয়েল ট্যুর”-এর মতো হবে। কিন্তু আনচেলত্তি প্রমাণ করে দিয়েছেন যে তিনি এখনও ট্যাকটিক্স, ম্যান-ম্যানেজমেন্ট এবং ফর্মেশন মিশ্রণের অদ্বিতীয় শিল্পী।

ট্রফির ঝুলিতে নতুন পালক

২০২১-২২ মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদকে লা লিগা এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ডাবল জয়ে নেতৃত্ব দেন আনচেলত্তি। এ ছাড়া স্প্যানিশ সুপার কাপ ও উয়েফা সুপার কাপ জিতে তিনি তার ট্রফির সংখ্যা আরও বাড়িয়ে তোলেন। তিনি হলেন প্রথম কোচ যিনি ইউরোপের পাঁচটি প্রধান লিগ (ইংল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন) জয় করেছেন। এটি এমন এক কীর্তি যা এখনও কেউ ছুঁতে পারেননি।

২০২4-২৫ মৌসুমে, যদিও তার বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠেছে, তবুও রিয়াল আবারও লা লিগার শিরোপা দখল করেছে এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে। এমনভাবে ক্লাবকে গৌরবের চূড়ায় নিয়ে গিয়ে বিদায় নেয়া যেন এক নিখুঁত স্ক্রিপ্ট।

আনচেলত্তি

খেলোয়াড়দের প্রতি তার প্রভাব

আনচেলত্তির কোচিং কৌশলের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি শুধুমাত্র খেলোয়াড়দের দক্ষতার ভিত্তিতে দল সাজাননি, বরং তাদের মানসিক অবস্থাও মূল্যায়ন করেছেন। ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, কামাভিঙ্গা, ফেডে ভালভার্দে কিংবা রদ্রিগো—সবাই তার অধীনে নিজেদের সেরা ভার্সন খুঁজে পেয়েছে।

তাকে বলা হয় “players’ coach”, অর্থাৎ খেলোয়াড়রা যাকে ভালোবাসে, যার নেতৃত্বে খেলতে তারা আত্মবিশ্বাসী অনুভব করে। এমনকি বেঞ্চে থাকা খেলোয়াড়রাও জানে—এই কোচ তাদের ওপর আস্থা রাখেন। যে কারণে রিয়ালের স্কোয়াডে একটা দৃঢ় বন্ধন ও ঐক্য দেখা যায়, যা অন্য ক্লাবে বিরল।

ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে

আনচেলত্তির বিদায়ের পেছনে যেমন বয়স ও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত আছে, তেমনি আছে নতুন দায়িত্ব গ্রহণের ইঙ্গিত। গুঞ্জন রয়েছে, তিনি ব্রাজিল জাতীয় দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব নিতে পারেন। যদি তা সত্য হয়, তবে বিশ্ব ফুটবলে আরও এক অধ্যায়ের সূচনা হবে এই মহান কোচের জন্য।

রিয়াল মাদ্রিদের জন্য এটি অবশ্যই এক যুগের সমাপ্তি। তবে একই সঙ্গে এটা নতুন যুগের সূচনাও। কারণ আনচেলত্তির রেখে যাওয়া অবদান, খেলার ধরন, ড্রেসিং রুমের পরিবেশ—সবই ভবিষ্যৎ কোচদের জন্য একটা মানদণ্ড তৈরি করে দিয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

 


 

আনচেলত্তির ব্রাজিল দলে ফিরতে কতটা প্রস্তুত নেইমার?


বিদায়ের আবেগ

সান্তিয়াগো বার্নাবেউয়ের গ্যালারিতে যখন হাজারো সমর্থক “গ্রাচিয়াস মিস্টার” বলে তাকে বিদায় জানাবে, তখন হয়তো তার চোখেও জল আসবে। কারণ রিয়াল মাদ্রিদ তার কাছে শুধু একটা চাকরি নয়, এটা ছিল একটা ভালোবাসার জায়গা।

আনচেলত্তির রিয়াল যাত্রা ছিল আনন্দ, সংগ্রাম, কৌশল এবং জয়মাল্য দিয়ে মোড়ানো এক মহাকাব্য। তিনি বিদায় নিচ্ছেন ইতিহাস গড়ে—একজন কোচ হিসেবে, একজন অভিভাবক হিসেবে, এবং একজন কিংবদন্তি হিসেবে।

শেষ কথা
কার্লো আনচেলত্তির বিদায় মানে রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের ইতি। তবে তার রেখে যাওয়া প্রভাব, স্মৃতি এবং শিক্ষা রয়ে যাবে অনন্তকাল। তিনি শুধু ট্রফি জিতিয়ে যাননি, তিনি তৈরি করেছেন বিশ্বাস, ঐক্য ও ভালোবাসার এক অপূর্ব সংস্কৃতি।
বিদায় “মিস্টার”, আপনার যাত্রা ছিল অনবদ্য।

হালা মাদ্রিদ, আনচেলত্তি এম্পেরাদর!

1 thought on “রিয়ালের হয়ে যে ইতিহাস গড়ে বিদায় নিচ্ছেন আনচেলত্তি”

Leave a Comment